শ্রীহট্ট থেকে “সিলেট”

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত একটি প্রাচীন জনপদ সিলেট। ৩৪৫২.০৭ বর্গ কিলোমিটারের জায়গায় প্রায় ৩৬ হাজার জন লোকের বসবাস। এর উত্তরে রয়েছে ভারতের খাসিয়া, জৈন্তিয়া পাহাড় যা ভারতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে মৌলভীবাজার জেলা, পূর্বে ভারতের কাছাড়, করিমগঞ্জ জেলা যা ভারতের আসাম রাজ্য এবং পশ্চিমে সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলা বেষ্টিত। এটি দেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী ও বিশ্বের দ্বিতীয় লন্ডন হিসেবেও পরিচিত। ৬টি সংসদীয় আসন বিশিষ্ট জেলা এটি।
ঐতিহাসিকভাবে বেশ প্রাচীন এই জেলাটি শ্রীহট্ট নামে পরিচিত ছিল। হিন্দু পৌরাণিক অনুসারে শ্রী অর্থ প্রাচুর্য বা সৌন্দর্য এবং হসত্ম অর্থ হাত, অর্থাৎ যেখানে শ্রী এর হসত্ম পাওয়া গিয়েছিল তাই শ্রীহস্ত। পরবর্তীতে কালের বিবর্তনে শব্দটি শ্রীহট্ট নামে রূপান্তরিত হয়। আবাস সুলতানি আমলে এর নাম ছিল জালালাবাদ। এছাড়াও অনেকে মনে করেন সিলেট শব্দের অনুস্বর্গ ফিল মানে শীল বা পাথর এবং উপসর্গ মানে আর অর্থাৎ বাজার, প্রাচীনকাল থেকে এখানে পাথর ও হার্টের প্রাধান্য ছিল বলে এ দুটি শব্দের সমন্বয়ে সিলেট নামের উৎপত্তি হয়েছে।
৬৪০ খ্রিস্টাব্দে চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এর এক ভ্রমণ বিবরণী থেকে সিলেট সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। হরিকেল ও কামরূপের বৌদ্ধ ও হিন্দু রাজ্যগুলির দ্বারা শাসিত হওয়ার পর মধ্যযুগের প্রথমদিকে সেন ও দেব বংশের নিয়ন্ত্রনে ছিল এটি। চতুর্দশ শতাব্দীতে পশ্চিমবঙ্গের লখনৌতে অবস্থিত শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের স্বতন্ত্র রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত হয়ে অঞ্চলটি জালালাবাদ নামে পরিচিত হয়েছিল। পরবর্তীতে কররানী রাজবংশ দ্বারা ১৫৭৬ সাল পর্যন্ত এটি শাসিত হয়। এরপর ১৬১২ সালে মুঘল শাসনের অধীনে আসে এটি।
১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে এ অঞ্চল ব্রিটিশদের আওতাধীন হলে ১৭৭২ সালের ১৭ মার্চ সিলেট জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানকার প্রথম কালেক্টর হিসেবে নিয়োগ পান উইলিয়াম থ্যাকারে। ব্রিটিশ আমলেই সিলেট দ্রুত বিকাশ লাভ করে, এমনকি ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে এখানে পৌরসভাও সৃষ্টি করা হয়। পরবর্তীতে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুন মারাত্মক এক ভূমিকম্পে শহরটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেলেও পরবর্তীতে সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর ইউরোপীয় ধাচের আরো সুন্দর ও আধুনিক শহর গড়ে তোলা হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৮৩-৮৪ সালে বৃহত্তর সিলেট জেলা কে চারটি নতুন জেলায় ভাগ করা হয় এবং পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালের ১ আগস্ট সিলেট বিভাগের সূচনা ঘটে।
অচ্যুতচরণ চৌধুরী সহ ইতিহাসবিদরা ধারণা করেন গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদের সমস্ত উত্তর-পূর্বাঞ্চল নিয়ে গঠিত প্রাচীন কামরূপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল প্রাচীন শ্রীহট্ট বা সিলেট বিভাগ। গ্রিক বণিক টলেমির বাণিজ্য বিস্তার গ্রন্থে উল্লেখিত তথ্যমতে এটিকে একটি প্রাচীন জনপদ হিসেবে ধরা হয়। নিদনপুরে প্রাপ্ত ভাস্করভর্মন এর তাম্রলিপি এবং ভাটেরায় প্রাপ্ত আরো দুটি ঐতিহাসিক তাম্রফলক থেকে অনুমান করা হয় অঞ্চলটি প্রাচীনকালে হিন্দু রাজাদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। পরবর্তীতে হযরত শাহজালাল (র) এর মাধ্যমেই এ অঞ্চলে ইসলামের প্রসার ঘটে। তার সফরসঙ্গী হিসেবে ৩৬০ জন আউলিয়া এখানে আগমন করেছিলেন বলে সিলেট কে ৩৬০ আউলিয়ার দেশও বলা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে সিলেট সর্বমোট ৩ টি সেক্টরের অধীনে ছিল। এর মধ্যে ৩ নং সেক্টরে ছিল হবিগঞ্জ মহকুমা যার দায়িত্বে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে ছিলেন মেজর এ এন এম নুরুজ্জামান। ৪ নং সেক্টরের অধীনে ছিল সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল এবং পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট-ডাউকি সড়ক পর্যন্ত যার দায়িত্বে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে ছিলেন মেজর চিত্তরঞ্জন দাস। আর ৫ নং সেক্টরের অধীনে ছিল সিলেট-ডাউকি সড়ক থেকে সিলেট জেলার সমগ্র উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চল যার সেক্টর কমান্ডার হিসেবে ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী। এখানকারই কৃতিসন্তান জেনারেল এম এ জি ওসমানী ছিলেন মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি। যুদ্ধচলাকালীন সময়ে ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে সিলেটে অগ্রসরমান মিত্রবাহিনী এবং পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাহিনীর মধ্যে এক তুমুল যুদ্ধ সংগঠিত হয় যা সিলেটের যুদ্ধ বা সিলেটের আন্দোলন নামেও পরিচিত। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এটিই ছিল প্রথম বিমান হামলা।
সিলেটের প্রাচীন স্থাপত্য কীর্তির অন্যতম নিদর্শন হলো মির্জা জঙ্গলে অবস্থিত মনিপুরী রাজবাড়ী। সিলেট তথা গোটা বাংলাদেশেরই আদি সম্প্রদায়ের অন্যতম জনগোষ্ঠী হলো মনিপুরী। আর সিলেট অঞ্চলের কৃষ্টি-সংস্কৃতি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে রয়ে গেছে ভবনটির নির্মাণ শৈলী। বাড়িটি ছিল এককালে প্রভাবশালী রাজা গম্ভীর সিং এর। ধারণা করা হয় এই রাজবাড়ীটি নির্মিত হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীতে। বর্তমানে সংস্কারের অভাবে রাজা কর্তৃক নির্মিত সেই প্রাসাদের তিন-চতুর্থাংশের কোন অস্তিত্বই নেই।
সিলেটের ঐতিহ্যের মধ্যে সবার প্রথমেই আসে হযরত শাহজালাল (র) এর মাজার এর নাম। তিনি ছিলেন উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত দরবেশ ও পীর। মাজার চত্বরের উত্তর দিকে একটি পুকুর রয়েছে যেখানে অসংখ্য গজার মাছ রয়েছে। ২০০৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে পুকুরের প্রায় ৭০০ এর বেশি গজার মাছ হত্যা করা হয় যাদেরকে মসজিদের পশ্চিম দিকের গোরস্থানে পুঁতে ফেলা হয়। এছাড়াও এখানে রয়েছে অনেকগুলো সুরমা রঙের কবুতর যারা জালালি কবুতর নামে পরিচিত।
প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেটের জাফলং যা প্রকৃতি কন্যা হিসেবে সারাদেশে এক নামে পরিচিত। সীমান্ত নিকটবর্তী এলাকাটিতে রয়েছে ডাউকি পাহাড় থেকে অবিরাম ধারায় প্রবাহমান জলপ্রপাত, ঝুলন্ত ডাউকি ব্রিজ, পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ হিমেল পানি এবং উঁচু পাহাড়ের গহীন অরণ্য। সিলেটে এসে জাফলং না গেলে যেন ভ্রমণই অপূর্ণ রয়ে যায়। সিলেট নগরী থেকে ৬২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে গোয়াইনঘাট উপজেলায় জাফলং এর অবস্থান। এটি বিউটি স্পট, পিকনিক স্পট, সৌন্দর্যের রাণী নামেও পর্যটকদের কাছে পরিচিত। ইতিহাস থেকে জানা যায় হাজার বছর ধরে জাফলং ছিল খাসিয়া জৈন্তা রাজার অধীন নির্জন বনভূমি। পরবর্তীতে ব্যবসায়ীরা পাথরের সন্ধানে নৌপথে এখানে আসেন। বর্তমানে জাফলং দেশের সেরা পর্যটন স্পট।
১৯৯১ সালে খানবাহাদুর আবু নছর মোহাম্মদ এহিয়া ওরফে জিতু মিয়া নির্মিত বাড়িটি সিলেট নগরীর শেখঘাট কাজীর বাজারের দক্ষিণ সড়কের ধারে ১ দশমিক ৩৬৫ একর ভূমি জুড়ে অবস্থিত। ইতিহাস থেকে জানা যায় নবাবি আমলে আবু নূর মোহাম্মদ ইদ্রিস কাজী হয়ে সিলেটে আসেন। সুরমা নদীর তীরে তার বিচারালয়কে কেন্দ্র করে তৎকালীন সময়ে একটি গঞ্জ গড়ে ওঠে যা খান বাহাদুর গঞ্জ বাজার বলে লোকমুখে প্রচলন ঘটে। সিলেটের পরিচিতিতে একটি লোকগাথা প্রচলিত রয়েছে যা এমন- চাঁদনী ঘাটের সিঁড়ি, আলী আমজাদের ঘড়ি, বন্ধু বাবুর দাড়ি আর জিতু মিয়ার বাড়ি।
সিলেট নামের উচ্চারণের সাথে যে নামটি বেশ গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয় তা হলো ক্বীনব্রিজ। এটি হলো সিলেটের প্রবেশদ্বার। যুগ-যুগান্তরের ইতিহাস বয়ে বেড়াচ্ছে সুরমা নদীর উপর অবস্থিত এই ক্বীনব্রিজ। ইতিহাস মতে গত শতকের ত্রিশের দশকের দিকে আসাম প্রদেশের গভর্নর মাইকেল ক্বীন সিলেট সফরে আসেন বলে তার স্মৃতি ধরে রাখতেই এ ব্রিজটি নির্মিত হয়। ১৯৩৩ সালে সুরমা নদীর উপর ব্রিজটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয় রেলওয়ে বিভাগ এবং পরবর্তীতে ১৯৩৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিজটি খুলে দেয়া হয়। এটি লোহা দিয়ে তৈরি যার আকৃতি ধনুকের ছিলার মত বাঁকানো। ১৫৫ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১৮ প্রস্থ বিশিষ্ট ব্রিজটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৫৬ লাখ টাকা।
মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার পৃথিম পাশা জমিদার আলী আমজাদ ১৮৭৪ সালে সিলেট জেলার সুরমা নদীর তীরবর্তী স্থানে একটি সুন্দর স্থাপনা তৈরি করেন যা আলী আমজাদের ঘড়ি নামে পরিচিত। জমিদার নিজস্ব তহবিলে ঘড়িটি নির্মাণ করেন যা প্রায় ১৪০ বছর ধরে তাঁর স্মৃতি বহন করে আসছে। বর্তমানে সিলেট জেলার এটি একটি অন্যতম পর্যটন আকর্ষণীয় স্থান।
এছাড়াও সিলেট মনিপুরী মিউজিয়াম, মনিপুরী রাজবাড়ী, মিউজিয়াম অব রাজাস, সিলেটি নাগরী লিপি, হাকালুকি হাওর, মালনীছড়া চা বাগান, বঙ্গবীর ওসমানী শিশু পার্ক এবং শাহী ঈদগাহ দেশের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ।