বাংলার ভেনিস “বরিশাল”

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি জেলা বরিশাল যা দেশের খাদ্যশস্য উৎপাদনের মূল উৎস। এটি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি নদী বন্দর যাকে বাংলার ভেনিস বলা হয়। ২,৭৮৪.৫২ বর্গ কিঃ মিঃ আয়তনের এই জেলায় প্রায় ২৫ হাজার মানুষের বসবাস। এটি উত্তরে চাঁদপুর, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলা, দক্ষিণে ঝালকাঠি, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলা, পূর্বে লক্ষ্মীপুর জেলা ও মেঘনা নদী এবং পশ্চিমে পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও গোপালগঞ্জ জেলা বেষ্টিত। এখানে ১ টি সিটি কর্পোরেশন এবং ৬ টি সংসদ নির্বাচনী এলাকা রয়েছে।
১৭৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই জেলার পূর্ব নাম চন্দ্রদ্বীপ যা চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত এই নামেই পরিচিত ছিল। তারও পূর্বে বাকলা নামে পরিচিত ছিল অঞ্চলটি। বাকলা একটি আরবী শব্দ যার অর্থ শস্য ব্যবসায়ী। প্রাচীন বৈদেশিক মানচিত্রে বড় বড় অক্ষরে অঙ্কিত দেখা যায় বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নামটি যেটি ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই নামেই পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে ১৭৯৭ সালে ঢাকার দক্ষিণাংশ নিয়ে বাকেরগঞ্জ জেলা প্রতিষ্ঠিত হলে অঞ্চলের সদরদপ্তর বাকেরগঞ্জ থেকে বরিশালে স্থানান্তরিত করে নামকরণ করা হয় গিরদে বন্দর।
বরিশাল নামকরণ নিয়ে অনেক মতভেদ দেখা যায়, এমনকি একটি প্রবাদ রয়েছে এমন – আইতে শাল, যাইতে শাল, তার নাম বরিশাল। কিংবদন্তিদের মতে পূর্বে এখানে বড় বড় শাল গাছ জন্মাতো বলে বড় + শাল = বরিশাল নামের উৎপত্তি। আবার অন্য মতে পর্তুগিজ বেরি ও শেলির প্রেম কাহিনী থেকে বরিশাল নামকরণ হয়েছে। অপর একটি ধারণা থেকে মনে করা হয় এ জেলার লবণের বড় বড় চৌকি ও লবণের বড় বড় দানার জন্য ইংরেজ বণিকরা অঞ্চলটিকে বরিসল্ট বলত যা থেকে পরিবর্তিত হয়ে বরিশাল শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে।
১৮০০ সাল পর্যন্ত অঞ্চলটি হিন্দু অধ্যুষিত ছিল এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন এলাকা থেকে মুসলমানদের আগমন ঘটে এখানে। ঐতিহ্যবাহী মানব গোষ্ঠীর বংশধর হলো এ অঞ্চলের অধিবাসীরা। ১৮৭৬ সনে প্রকাশিত বরিশালের কালেক্টর ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হেনরী বেভারিজের একটি বই থেকে জানা যায়, বাঙালি চরিত্রের খাঁটি নিদর্শন হলো বাকেরগঞ্জের অধিবাসী। আবার সিরাজউদ্দিন আহমেদের বরিশালের ইতিহাস গ্রন্থ মতে বাঙালি জাতির আদি বাসস্থান ছিল চন্দ্রদ্বীপ। এছাড়াও বাকলা সমাজ নামে পরিচিত ছিল এখানকার কুলীন সমাজ। আর চন্দ্রভদ্র নামে এক জাতির বসবাস ছিল এই বরিশাল অঞ্চলে।
স্বাধীনতা যুদ্ধে সমগ্র বাংলাদেশকে যে ১১ টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়েছিল, তন্মধ্যে বরিশাল জেলার অবস্থান ছিল ৯ নং সেক্টরে। ২ জন সেক্টর কমান্ডারের অধীনে জেলা টি স্বাধীন হয়েছিল। একজন ছিলেন মেজর এম এ জলিল যিনি ১০ এপ্রিল থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। আর অপরজন মেজর জয়নুল আবেদিন ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ঐতিহ্যের দিক থেকে বরিশালের কোন তুলনা নেই। এখানকার গ্রামাঞ্চলে পীর এবং মাওলানাদের প্রভাব অত্যন্ত বেশি এবং এখানকার মুসলমানরা সাধারণভাবে অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ। আবার হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেও এখানে নমঃশূদ্র ও বর্ণহিন্দুদের স্থান রয়েছে। তবে এখানকার জনগণ সত্যিকার অর্থেই আরামপ্রিয় ও ভোজনবিলাসী এবং পারিবারিকভাবেও এরা খুবই ঘনিষ্ঠ ও আন্তরিক। সুস্বাদু খাবারের পর তাদের তৃপ্তি আসার জন্য মিষ্টান্ন লাগেই। খেজুরের রস, গুড়, নারিকেল এবং দুগ্ধ ছানার তৈরি প্রায় ১০০ এর কাছাকাছি প্রকারের পিঠা এখানকার ঐতিহ্যের ধারক।
বাংলার বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম রাজা কন্দর্পনারায়ণের পুত্র রামচন্দ্র পঞ্চদশ শতকের শেষদিকে বরিশাল শহরের কাছে মাধবপাশা নামক স্থানে বাংলার রাজধানী স্থাপন করে এর নামকরণ করেন শ্রীনগর। সেই প্রাচীন রাজবাড়ী ও মন্দির সমূহের ধ্বংসাবশেষ কালের সাক্ষীরূপে ইতিহাসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এছাড়াও বরিশাল শহরের উত্তর দিকে গৌরনদীর কসবা নামক স্থানে বহু গম্বুজ বিশিষ্ট একটি প্রাচীন মসজিদ রয়েছে যার সাদৃশ্য রয়েছে বাগেরহাটের নয় গম্বুজ মসজিদ ও খুলনা মসজিদকুড়ের মসজিদের সাথে। যদিও কোন শিলালিপি নেই, তবুও মনে করা হয় যে স্থাপনাটি পঞ্চদশ শতাব্দীতে নির্মাণ করা হয়েছিল। কালের নির্মমতায় দৈন্যদশা প্রাপ্ত হলেও কারুকার্য দর্শনীয় আরেকটি বিখ্যাত প্রাচীন মসজিদ হল বাকেরগঞ্জের কাছেই শিয়ালগুনি মসজিদ যার নির্মাতা হিসেবে মনে করা হয়ে থাকে নছরত শাহকে। বরিশালের প্রাপ্ত মূর্তি গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো লক্ষ্মণকাঠির বিষ্ণুমূর্তি। এছাড়াও এগারো শতকের একটি গরুর মূর্তি গৌরনদী থেকে উদ্ধার করা হয় যা এখন জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।
অসংখ্য প্রতিভাবান ব্যক্তি বরিশালের গর্ব যাদের নাম ইতিহাসে চিরকাল অম্লান হয়ে রয়েছে। যাদের নিয়ে না বললেই নয়, তারা হলেন –
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাঙালি কূটনীতিক হিসেবে পরিচিত রাজনীতিবিদ ছিলেন এ কে ফজলুল হক। রাজনৈতিক মহল এবং সাধারন মানুষের কাছে শেরেবাংলা নামে পরিচিত এ কে ফজলুল হক বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন যার কার্যকারিতা পরীক্ষায় ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৮ সালে ক্লাউড কমিশন গঠন করে। পরবর্তীতে ১৯৩৮ সালের ১৮ আগস্ট বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধনী পাস হয় এবং চিরদিনের জন্য জমিদারদের লাগামহীন অত্যাচার বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়াও তিনি ছিলেন যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রধান নেতাদের মধ্যে অন্যতম একজন।
১৯২১ সালে বরিশালের গৌরনদী উপজেলার সরাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আবদুর রব সেরনিয়াবাত। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা ছাড়াও মুজিবনগর সরকার গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন তিনি। এছাড়াও বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যও ছিলেন তিনি। এ মহান নেতা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নিহত হন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ১৯৪৯ সালে বরিশালের বাবুগঞ্জ থানার রহিমগঞ্জ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক পদক দেয়া হয় তাকে। তার নামানুসারে বরিশালে তার নিজ গ্রামের ইউনিয়নের নাম আগরপুর থেকে পরিবর্তন করে মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ইউনিয়ন করা হয়। এছাড়াও তার স্মৃতিতে জাদুঘর ও গ্রন্থাগার নির্মিত হয়েছে।
রবীন্দ্র পরবর্তীকালে বিশ শতকের অন্যতম প্রধান আধুনিক বাংলা কবি হলেন জীবনানন্দ দাশ। ১৯৫৪ সালে অকাল মৃত্যুর আগে তিনি ১৪ টি উপন্যাস এবং ১০৮ টি ছোট গল্প রচনা করেছিলেন যার কোনোটিই জীবদ্দশায় তিনি প্রকাশ করেননি। তার নাম আজও বিখ্যাত কবির মর্যাদায় লালিত হয়।
বাঙালি একজন মহিলা কবি ছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশের মা কুসুমকুমারী দাশ। ছোটবেলা থেকেই তিনি কবিতা ও প্রবন্ধ লিখতেন। সম্পাদক মনোমোহন চক্রবর্তীর অনুরোধে তিনি ব্রহ্মবাদী পত্রিকায় লিখেছেন। প্রবাসী ও মুকুল পত্রিকায়ও তার অল্প কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। তার কবিতায় বার বার ধর্ম, নীতিবোধ ও দেশাত্ববোধ উঠে এসেছে।
১৮৫৬ সালে বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলার অন্তর্গত বাটাজোরের একটি ছোট্ট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন অশ্বিনী কুমার দত্ত যার পিতা ব্রজমোহন দত্ত ছিলেন একজন সাব-জজ। সমাজের কল্যাণ এবং উন্নয়নে নিবেদিত প্রাণ অশ্বিনী কুমার দত্ত নিজের দান করা এলাকায় ১৮৮৪ সালে ব্রজমোহন বিদ্যালয় এবং ১৮৮৯ সালে ব্রজমোহন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। সেই কলেজেই বিনা বেতনে তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে দীর্ঘ কুড়ি বছর শিক্ষা দান করেন। বঙ্গভঙ্গে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।
বাংলাদেশের নারীজাগরণ আর সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এক উজ্জ্বল পথপ্রদর্শক সুফিয়া কামালের জন্ম এখানেই। ১৯২০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তিনি শরিক হয়েছিলেন, এমনকি কারফিউ উপেক্ষা করে নীরব শোভাযাত্রাও বের করেছিলেন। তিনি মুক্তবুদ্ধির পক্ষে এবং সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিপক্ষে আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন।
আলতাফ মাহমুদ একজন বাংলাদেশী সুরকার, সাংস্কৃতিক কর্মী, স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং ভাষাসৈনিক ছিলেন। তিনি শহীদ দিবসে গাওয়া আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটির বর্তমান সুরকার। আব্দুল লতিফ এই গানটির প্রথম সুর করেছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে আলতাফ মাহমুদ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তার বাসায় গোপন ক্যাম্প স্থাপন করেন। পরবর্তীতে ক্যাম্পের কথা ফাঁস হয়ে গেলে ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট পাকিস্তানী বাহিনী তার বাসা থেকে বেশ কয়েকজন গেরিলা যোদ্ধা সহ তাকেও আটক করে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত তার দেশাত্মবোধক গান অগনিত মুক্তিযোদ্ধাকে অনুপ্রাণিত করেছিল।
পঞ্চাশ দশকের সঙ্গে চিহ্নিত বাংলাদেশের একজন কবি আবু জাফর মুহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ খানের জন্ম বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জের বাহেরচরে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারে অভূতপূর্ব সংযোজন হল তার দুটি দীর্ঘ কবিতা ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’ এবং ‘বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা’। ১৯৮০’র দশকে বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি।
ভাষা আন্দোলনের স্মরণীয় গান আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো এর রচয়িতা আব্দুল গাফফার চৌধুরী একজন সুপরিচিত বাংলাদেশী গ্রন্থকার ও কলাম লেখক যিনি বরিশাল জেলার উলানিয়ার চৌধুরী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের শীর্ষ দৈনিকগুলোতে তার রাজনীতি, সমসাময়িক ঘটনা ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী নিয়ে লেখা কলাম অত্যন্ত জনপ্রিয়।
বরিশালের অন্যতম দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে কলস কাঠি জমিদার বাড়ি, পাদ্রিশিবপুর গির্জা, কীর্তনখোলা নদী, বঙ্গবন্ধু উদ্যান এবং শাপলা বিল ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি স্থান। জলবেষ্টিত এ অঞ্চলটি দর্শনার্থীদের কাছে ভ্রমণের জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয়।