দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একটি মেগাসিটি- “ঢাকা”

বাংলাদেশ – অপার সৌন্দর্য্যে পূর্ণ আমাদের মাতৃভূমি। এর পরতে পরতে রয়েছে না জানা অসংখ্য ইতিহাসের হাতছানি। আমরা কতটুকুই বা জানি নিজের দেশ সম্পর্কে! ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গ মাইলের এই দেশে ৬৪ টি জেলা। প্রতিটি জেলার রয়েছে স্বকীয়তা। নিজস্ব সংস্কৃতি, কৃষ্টি আর ইতিহাসে এক জেলা আরেক জেলা থেকে নিজেকে করেছে অনন্য। আমরা অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তার কতটুকুই বা বিশ্লেষণ করেছি! কবি তবে যথার্থই তাঁর ভাষায় –
“দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।”
ঢাকা – শুধুমাত্র দেশের রাজধানী-ই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একটি মেগাসিটিও বটে। ১৬৬৩.৬০ বর্গ কিমি. বিশিষ্ট এই জেলায় প্রায় ১ কোটি ২৬ লক্ষ লোক বসবাস করে। উত্তরে গাজীপুর ও টাঙ্গাইল জেলা, দক্ষিণে মুন্সিগঞ্জ ও রাজবাড়ী জেলা, পূর্বে নারায়ণগঞ্জ জেলা এবং পশ্চিমে মানিকগঞ্জ জেলা বেষ্টিত এর অবস্থান। জেলার সংসদীয় আসন সংখ্যা মোট ২০ টি।
ইতিহাস গ্রন্থানুসারে খ্রিস্টিয় ৭ম শতক থেকে এখানে মানুষের বসবাস শুরু হয়। নামকরণ নিয়ে অনেক মতবাদ থাকলেও সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হিসেবে মনে করা হয় যে রাজা বল্লালসেন কর্তৃক নির্মিত ঢাকেশ্বরী মন্দির (ঢাকা + ঈশ্বরী) এর ঢাকা থেকেই এর নামের উৎপত্তি হয়েছে। তবে ১৬১০ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর এবং রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের আগ মুহূর্তে ঢাকার রাজধানীত্ব কেড়ে নিয়ে মুর্শিদাবাদকে সেই মর্যাদা দেয়া হয়েছিল। এর পর প্রায় ১৯০ বছর জেলাটি ব্রিটিশ শাসনের অধীনস্থ হিসেবে পরিচালিত হয়েছিল। পরে আবার ১৯৪৭ সালে পূর্ব বঙ্গ গঠিত হলে ঢাকাকে আবার রাজধানীর মর্যাদা দেয়া হয় এবং পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালের ২৩শে মার্চ একে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। সর্বশেষ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটলে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ঢাকা-কে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
ইতিহাসে যতগুলো আন্দোলন রয়েছে, সবগুলোতে-ই ঢাকার অসীম অবদান লক্ষ্যণীয়। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান, অসহযোগ আন্দোলন, এমনকি স্বাধীনতা যুদ্ধেও ঢাকা সর্বদা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এসেছে। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান যা বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকেই দেয়া হয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক। মুক্তিযুদ্ধে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশকে ১১ টি সেক্টরে বিভক্তের সময় ঢাকার অবস্থান হয় ২ নং সেক্টরে। দুইজন সেক্টর কমাণ্ডারের অধীনে ছিল এই সেক্টরটি। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এই সেক্টরের কমাণ্ডার ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ এবং পরবর্তীতে অক্টোবর থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন মেজর এটিএম হায়দার।
অন্যতম প্রাচীন একটি শহর হিসেবে ঢাকায় ঐতিহাসিক স্থানসমূহেরও ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল –
ছোট কাটরা যা শায়েস্তা খানের আমলে তৈরি করা হয়েছিল। ধারণা করা হয় যে ১৬৬৩ থেকে ১৬৬৪ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ১৬৭১ সালে সমাপ্ত হয়। শায়েস্তা খানের আমলে মূলত প্রশাসনিক কাজের জন্য ব্যবহৃত হত এটি। পরবর্তীতে ১৮১৬ সালে ইংরেজ মিশনারি লিওনার্দ এখানে ঢাকার প্রথম ইংরেজি স্কুল চালু করেছিলেন। দুঃখের বিষয় হলেও সত্যি যে বর্তমানে এর অস্তিত্বে শুধুমাত্র একটি ভাঙা দালান ছাড়া আর কিছুই বাকি নেই।
বড় কাটরা যা প্রায় ৩৭৫ বছর পূর্বে শায়েস্তা খানের জামাতা-র নির্মিত একটি দূর্গ। পরবর্তীতে এখানে একটি মাদ্রাসা স্থাপিত হয় যা হোসাইনিয়া আশরাফুল উলুম মাদ্রাসা নামে পরিচিত। বর্তমানে সেই মাদ্রাসাটি-ই চালু রয়েছে।
লালকুটি যা নগর মিলনায়তন হিসেবে ১৮৭২ থেকে ১৮৭৬ সালের মধ্যে স্থাপিত হয়েছিল। এটি নর্থব্রুক হল নামেও পরিচিত। দেয়ালের লাল রঙের কারণেই মূলত এটি লালকুটি নামে অত্যধিক পরিচিত ছিল। বর্তমানে এটি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের অধীনস্থ, এমনকি কালের পরিক্রমায় এখানে নির্মাণ করা হয়েছে মঈন উদ্দিন চৌধুরী মেমোরিয়াল হল, কমিশনার কার্যালয়, স্পোটিং ক্লাব, কমিউনিটি সেন্টার, ব্যায়ামাগার, বিট পুলিশিং অফিস, ডায়াবেটিস সমিতিসহ আরও বেশকিছু কার্যক্রমও চলে এখানে।
লালবাগ কেল্লা যা বাংলাদেশে কষ্টি পাথর, মার্বেল পাথর আর নানান রঙবেরঙের টালি বিশিষ্ট মোঘল আমলের একমাত্র ঐতিহাসিক নিদর্শন। এটি ছাড়া বাংলাদেশের অন্য কোনও ঐতিহাসিক নিদর্শনে এরূপ সংমিশ্রণ পাওয়া যায় নি। ১৬৭৮ সালে মুঘল সম্রাট আজম শাহ এর নির্মাণ কাজ শুরু করলেও এক বছরের মাথায় তাঁকে দিল্লি ফেরত যেতে হয় বলে এর নির্মাণ কাজও বন্ধ হয়ে যায়। পরে শায়েস্তা খাঁ নির্মাণ কাজ শুরু করলেও চার বছরের মাথায় তাঁর মেয়ে পরী বিবির মৃত্যুর কারণে এর নির্মাণ কাজ অসমাপ্ত অবস্থাতেই পুনরায় বন্ধ হয়ে যায়। মৃত্যুর পর পরী বিবিকে কেল্লার মাঝেই সমাহিত করা হয় বলে এটি পরী বিবির সমাধি নামেও আখ্যায়িত হয়। তবে শুরুর দিকে এর নাম ছিল “কেল্লা আওরঙ্গবাদ” এবং পরবর্তীতে লালবাগে অবস্থিত হওয়ায় জায়গার নামানুসারে এটি লালবাগের কেল্লা নামেই পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানেও এটি ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে যথার্থ মর্যাদায় দর্শনীয় স্থান হিসেবে চালু রয়েছে।
আহসান মঞ্জিল যা ১৮৩০ সালে ফরাসীদের কাছ থেকে নওয়াব আবদুল গনির পিতা খাজা আলিমুল্লাহ ক্রয় করে মেরামতের মাধ্যমে বসবাস উপযোগী করেন। পরবর্তীতে ১৮৬৯ সালে নওয়াব আবদুল গনি পুনঃসংস্কার করে পুত্র খাজা আহসানুল্লাহর নামে এর নামকরণ করেন। চোখ ধাঁধানো অলংকরণ এই নির্মাণটিকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যের মর্যাদা দিয়েছে। বর্তমানে ২৩ টি গ্যালারি বিশিষ্ট এই মঞ্জিলটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
হোসেনী দালান যা শিয়া সম্প্রদাআয় কর্তৃক ১৮৯১ সালে নির্মিত হয়। পরবর্তীতে ২০০৪ সালে পুনঃসংস্কার করা হয়। মহররম মাসে শিয়া সম্প্রদায় যে মিছিল বের করে তা মূলত এখান থেকেই পরিচালিত হয়।
তারা মসজিদ যা ঢাকার জমিদার মির্জা গোলাম পীর বা মির্জা আহমদ জান খ্রিস্টীয় আঠারো শতকে নির্মাণ করেছিলেন। এটি মির্জা গোলাম পীরের মসজিদ বা সিতারা মসজিদ নামেও পরিচিত। এটি নির্মিত হয়েছিল সতের শতকে দিল্লি, আগ্রা ও লাহোরে নির্মিত মোঘল স্থাপত্য শৈলী অনুসরণে। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার তৎকালীন স্থানীয় ব্যবসায়ী, আলী জান বেপারী মসজিদটির সংস্কারকালে এর মেঝে চিনিটিকরি মোজাইক – যাতে জাপানী রঙিন চীনা মাটির টুকরা এবং রঙিন কাঁচের টুকরা ব্যবহৃত, করেন। ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে পুনঃসংস্কারের সময় পুরণো একটি মেহরাব ভেঙে দুটি গম্বুজ আর তিনটি মেহরাব স্থাপন করা হয়। বর্তমানে ৫ টি গম্বুজ নিয়ে এটি স্বীয় অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে।
ঢাকার প্রথম সরকারী বিদ্যালয় কলেজিয়েট স্কুল যা ১৯৩৫ সালের ১৫ই জুলাই প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম সরকারী কলেজ ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৪১ সালে। আর প্রথম বেসরকারী কলেজ ছিল জগন্নাথ কলেজ। প্রথম মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল কলেজ। ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম বাংলা সংবাদপত্রের নাম ছিল ঢাকা প্রকাশ।
সৌন্দর্য্য আর ঐতিহ্যে ঘেরা ঢাকার রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি, আর এই সংস্কৃতি-ই একে অনন্য করে রেখেছে অন্যদের থেকে। বর্তমানে ব্যস্তমূখর এই নগরীর প্রতিটি ইঞ্চিতে যে ইতিহাসের বুনন রয়েছে, তা অনেকটাই হারিয়ে গেলেও কিছুটা আঁকড়ে ধরে স্ব-মহিমায় নিজেকে জাহির করে যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে।