“ইউনিকর্ন “– এক আশ্চর্য রূপকথা নাকি অদ্ভূত বাস্তবতা

আমাদের পৃথিবীতে অনেক ধরনের প্রাণী রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতার এসব প্রাণীর বাইরেও অনেক প্রাণী আমরা কল্পনায় চিত্রায়ন করি। আর সেসব প্রাণীদের নিয়ে আমাদের উৎসাহ কিংবা আগ্রহের কোনও অন্ত নেই। তেমনি এক প্রাণী – ইউনিকর্ন। ইউনিকর্ন নিয়ে অনেক অনেক কাহিনী শুনে এসেছি, পড়ে এসেছি আমরা সেই ছোটবেলা থেকেই। আর তাতে করেই বয়স বাড়ার সাথে সাথে ইউনিকর্ন নিয়ে জানার আগ্রহটাও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। আসলেই কি ইউনিকর্নের অস্তিত্ব পাওয়া সম্ভব? জেনে আসা কাহিনীগুলো কি সত্যি? এরকম অনেক প্রশ্ন প্রতিনিয়ত ঘোরপাক খায় আমাদের মনে।
প্রাচীন রূপকথা-উপকথায় যে ক’টি প্রাণী নিয়ে বিস্তর চর্চা হয়েছে, তাদের মধ্যে ইউনিকর্ন অন্যতম। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল প্রাচীন গ্রীস থেকে শুরু করে ভারত, মেসোপটেমিয়া, চীন – সব সংস্কৃতিতেই একে নিয়ে বিভিন্ন উপকথা রয়েছে। আরো মজার ব্যাপার হল একেক সংস্কৃতিতে এর বর্ণনা একেক রকম। প্রাচীন স্বনামধন্য বহু পন্ডিত এর ব্যাপারে বিভিন্ন কথা বলেছেন যাদের মধ্যে বাদ যাননি এরিস্টটল, টিসিয়াস, প্লিনি, স্ট্র্যাবো কিনবা মার্কো পলোও।
চীনের ইউনিকর্ন হিসেবে বলা হয় কি-লিন নামক এক জন্তুকে। আবার এর মিল খুঁজে পাওয়া যায় গ্রীক উপকথার কাইমেরা নামক প্রাণীর সাথে। সিংহের মতো দেখতে মাথার সাথে সবুজ আঁশযুক্ত হরিণ সদৃশ দেহের এই প্রাণীটির মাথার ঠিক মধ্যভাগে রয়েছে একটি লম্বা শিং। ধারণা করা হয় যে জাপানের কিরিণ নামক জন্তুটি আসলে চীনের এই কি-লিন। অসম্ভব শক্তির অধিকারী হলেও স্বভাবত শান্তিপ্রিয় হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে একে।
আফ্রিকান কঙ্গো উপকথায় আবাদা নামের এক ইউনিকর্নের বর্ণনা রয়েছে যার গাধার মতো আকার, শুকরের লেজের মতো লেজ এবং দু’টি শিং রয়েছে। বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক হিসেবে এই শিং কাজ করত বলে মনে করা হত।
দক্ষিণ আমেরিকান চিলির উপকথায় ক্যামাহুয়েতো নামের এক প্রাণীর বর্ণনা আছে যার বর্ণনা অনেকটা ষাঁড়ের মতো পাওয়া যায়। এক শিং বিশিষ্ট এই প্রাণীটির শিং অনেক রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করত বলে ধারণা করা হত।
ইউরোপীয় উপকথায় ইউনিকর্নকে বর্ণনা করা হয় সাদা ঘোড়ার মতো যেমনটা আমরা সচরাচর কল্পনা করে থাকি। অসম্ভব ক্ষমতার প্রাণীটি সম্পর্কে ধারণা করা হত যে এর শিং পানির অপবিত্রতা দূর করতে পারে, এমনকি বিষের প্রতিষেধক হিসেবেও মনে করা হত।
ইতিহাসে ইউনিকর্নের প্রথম আবির্ভাব ঘটে টিসিয়াসের দ্বারা, যিনি ছিলেন একজন গ্রীক চিকিৎসক। ‘ইন্ডিকা’ নামক তাঁর লেখা বিখ্যাত একটি গ্রন্থে তিনি একে ভারতীয় বুনো গাধা হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি এর শিংগুলোকে আটাশ ফিট লম্বা এবং সাদা, লাল কিংবা কালো বলে বর্ণনা দেন, আরও বলেন যে প্রাণীটি আলোর গতিতে ছুটতে পারে।
বিখ্যাত দার্শনিক এরিস্টটলের বর্ণনাও টিসিয়াসের বর্ণনার সাথে অনেকটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ। এছাড়াও আরো অনেকে ইউনিকর্ন সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন যাদের মধ্যে স্ট্র্যাবো, প্লিনিও রয়েছেন। এমনকি মার্কো পলো খুব কাছ থেকে প্রাণীটি দেখেছেন বলেও দাবি করেছেন। তবে তাঁর দেখা প্রাণীটি গন্ডার বলেই ধারণা করা হয়।
ধর্মীয় ক্ষেত্রেও ইউনিকর্নের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। খ্রিস্টধর্মের চার্চের সাথে ইউনিকর্নের ঘনিষ্ঠতা লক্ষ্যণীয়। একে যিশুর অবতার হিসেবেও ধারণা করা হয়ে থাকে। সে সময়কার ধর্ম প্রচারকদের মতে ইউনিকর্নের কুমারী মেয়েদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া যিশুর কুমারী মা মেরীর নিকটবর্তী হওয়ারই রূপক উপস্থাপনা, এমনকি ইউনিকর্নের কুমারী মেয়েদের ঘুমিয়ে পড়াকেও যিশুর মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়ার সাথে তুলনা করা হত।
বাস্তবতার ইউনিকর্ন –
বাস্তবে ইউনিকর্নের দেখা না মিললেও এমন কিছু প্রাণী রয়েছে, যাদের দ্বারা ইউনিকর্নের অস্তিত্ব একসময় ছিল বলে ধারণা পোষণ করাটাও দোষের কিছু নয়। চলুন জেনে নিই সেসব প্রাণীদের নিয়ে কিছু তথ্য –
ইউনিকর্নফিশ নামে এক ধরনের মাছ রয়েছে যাদের দেখতে অনেকটা রূপকথার সেই ঘোড়াগুলোর মতোনই মাথায় লম্বা একটা শিংবিশিষ্ট। উষ্ণ পানিতে বাস করতে ভালোবাসা এই মাছগুলোর মাথার উপরের শিংটা বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে। সেই সাথে তাদের খাদ্যাভ্যাসও বদলে যায়। বিগনোজ ইউনিকর্নফিশ, হোয়াইটমার্জিন ইউনিকর্নফিশ সহ আরো বেশ কয়েক ধরনের ইউনিকর্নফিশ দেখতে পাওয়া যায় যার মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে ব্লু স্পাইন ইউনিকর্নফিশ। এদের মাথার শিং লম্বায় সর্বোচ্চ ৬ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে।
অসাধারণ জাদুকরী অনুভূতি ক্ষমতা এবং মাথার ওপর লম্বা একটা শিং বিশিষ্ট বাস্তবের ইউনিকর্ন বলা হয় নারহোয়েলকে। এরা খুব সহজেই চারপাশের অনেক জিনিস আগে থেকেই বুঝতে পারে। আর নিজেদের দেহের প্রায় অর্ধেকের সমান শিংগুলো প্রায় ২.৬ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। অনেকের মতে সেটা আসলে শিং নয়, বরং তাদের দাঁত যা দিয়ে তারা বরফ ভাঙ্গে। আবার অনেকের মতে নিজেকে সুদর্শন হিসেবে প্রমাণ করতেও লম্বা দাঁতের সাহায্য নেয় নারহোয়েলরা।
ইউনিকর্নের সাথে যে প্রাণীটার সর্বোচ্চ মিল খুঁজে পাওয়া যায় তা হল ইন্ডিয়ান রাইনোসোর। গন্ডারের মতন দেখতে প্রাণীটির প্রায় ৪ মিটারের বিশাল একটি দেহের সাথে মাথার উপরে ছোট্ট একটি শিং-ও রয়েছে যা কেরাটিন নামক জিনিস দিয়ে তৈরি। ক্যারাটিন হলো আমাদের নখ আর চুলের প্রধান উপকরণ। এশিয়ার সবচাইতে বড় গন্ডারদের মধ্যে তিন নম্বর অবস্থানে থাকা এই প্রাণীটির শিং সর্বোচ্চ ১ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। চীনা চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসারে এদের শিংয়ের গুড়ো অনেক ধরনের রোগের ওষুধ হিসেবে বেশ কাজে লাগে।
এশিয়ার ইউনিকর্ন নামে পরিচিত খানিকটা রহস্যময় প্রাণী হল শাওলা। ১৯৯২ সালে ভিয়েতনামের সীমানায় এক শিকারীর বাসায় প্রথম এদের খুলি দেখতে পাওয়া যায়। এদের মাথায়ও একটি শিং রয়েছে যা সর্বোচ্চ ৫০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। তবে বিভিন্ন ছবি আর খুলিতে তাদেরকে দেখতে পেলেও এখন পর্যন্ত সামনাসামনি তাদেরকে কেউ দেখতে পায়নি।
ইউনিকর্ন শব্দটা শুনলেই যে চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে তা হলো একটা ঘোড়া যার রয়েছে সাদা একটা শরীর, সেইসাথে লম্বা একটা শিং এবং পারলে খানিকটা দাড়ি। ঠিক সেরকমই একটি প্রাণী হল খানিকটা বাদামী গায়ের রঙের প্রাণী ওকাপি। এদের মাথার ওপর একটি নয়, বরং দুটো শিং রয়েছে। আফ্রিকান ইউনিকর্ন নামে পরিচিত প্রাণীটির স্বভাব অনেকটা জিরাফের সাথে মিল রয়েছে।
রূপকথা আমাদের কাছে সব সময় এক মোহাবিষ্ট কাহিনী হিসেবেই থাকবে। সেই সাথে ইউনিকর্নের মত রূপকথার প্রাণীগুলো নিয়েও আমাদের আগ্রহ যুগ-যুগান্তরে বয়ে বেড়াবে। এখন পর্যন্ত এ ধরনের রূপকথার কোন প্রাণীর অস্তিত্ব পাওয়া না গেলেও মানুষ তার রহস্যের আকাঙ্ক্ষা মেটাতে চিরকাল অনুসন্ধান অব্যাহত রাখবে। হয়তোবা কোন একদিন এভাবেই রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে কোন এক নতুন রহস্যের সন্ধান পাওয়া যাবে।